Blog
চিয়া সিডের অসাধারণ উপকারিতা: পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের জন্যে এক আদর্শ খাবার

বর্তমান সময়ে চিয়া সিড বা চিয়া বীজ বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করছে এর অসাধারণ সব উপকারিতা আর পুষ্টিগুণের জন্যে। একটা সময় মায়ান বা অ্যাজটেক জাতিদের মধ্যে এই বীজ গ্রহণ করার প্রচলন ছিল, তারা মূলত চিয়ার শক্তিবর্ধক গুণের জন্যেই এটি গ্রহণ করত।
কিন্তু এখন আমরা জানি, চিয়ার বহুমূখী উপকার রয়েছে আমাদের শরীরে। এমনকি অনেকে একে ‘সুপারফুড’ হিসেবেও অবহিত করেন।
তার কারণ হল, চিয়া সিড বা চিয়া বীজে রয়েছে উচ্চ পরিমাণের ফাইবার, ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, ভালো মাত্রার প্রয়োজনীয় খনিজ, এন্টিঅক্সিডেন্ট, আর প্রোটিন। নিয়মিত চিয়া সিড গ্রহণে যেমন পেট ভালো থাকে, তেমনি রক্তচাপ ও রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা হয়।
চিয়া সিড গ্রহণের আরো অনেক চমৎকারিত্ব রয়েছে। আর আজ আমরা সে সকল উপকারিতা সম্পর্কে জানব।
চিয়া সিড কী?
চিয়া বীজ বেশ ক্ষুদ্র ডিম্বাকৃতির সাদা, কালো, বা বাদামী বর্ণের দানা যা সালভিয়া হিসপানিকা উদ্ভিদ হতে সংগ্রহ করা হয়। মেক্সিকো বা আমেরিকায় এটি বেশি পাওয়া গেলেও আমাদের দেশের অনেক গ্রামেও চিয়া বীজের গাছ দেখা যায়।
এই বীজগুলো বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানে ঠাসা। যখন পানিতে ভেজানো হয়, বীজগুলো ফুলে উঠে আর তাদের ওজনের ১২ গুণ পর্যন্ত তরল শোষণ করে ফেলে। পানিতে ভেজানো হলে বীজগুলো তাদের চারপাশে একটা মিউসিলিনাস প্রলেপ তৈরি করে – যা দেখতে অনেকটা জেলির মতো।
চিয়া সিড শুধুমাত্র পানিতে ভিজিয়ে রেখেই শরবতের মতো ঢকঢক করে খেয়ে ফেলা যায়। অনেকে স্বাদবর্ধনের জন্যে যোগ করে আরো অনেক কিছু; যেমন লেবু, পুদিনা, বা কমলার রস। তবে রান্নার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যায় স্বাদ আর গন্ধবিহীন এই অদ্ভুত চমৎকার চিয়া সিড।
যেভাবেই খাওয়া হোক না কেন, দৈনিক ১-২ টেবিল চামচ (২০ গ্রাম) পর্যন্তই খাওয়া ভালো। অতিরিক্ত খেলে ডায়রিয়া, গ্যাস, পেট ফুলে উঠাসহ নানা ধরণের জটিলতা দেখা দিতে পারে।
চিয়া সিড এর অসাধারণ উপকারিতা
চিয়া সিডের যেমন রয়েছে পুষ্টিগুণ, তেমনি রয়েছে দেহে এর বিভিন্ন কার্যকর ব্যবহার। উচ্চ আঁশবিশিষ্ট খাবার হওয়াতে চিয়া সিড হজমে বিশেষ ভূমিকা রাখে, সেই সাথে ভালো রাখে পেটের স্বাস্থ্যও!
চলুন, জেনে নেওয়া যাক চিয়া বীজের অসাধারণ উপকারিতাগুলো-
১. পুষ্টিগুণে বহুগুণ
চিয়া সিডে এমন সব পুষ্টি উপাদান একত্রে পাওয়া যায়, যা কি না অন্য কোনো খাবার থেকে এত বেশি পরিমাণে পাওয়া সম্ভব না। এ কারণেই একে ‘সুপারফুড’ বলে থাকে অনেকে।
চিয়া সিডে আছে ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন, আয়রন, খাদ্যআঁশ, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, আর নানা ধরনের উদ্ভিজ্জ উপাদান।
সবচেয়ে চমৎকার ব্যাপারটি হল চিয়া সিড থেকে প্রাপ্ত পুষ্টি উপাদান আমাদের পরিচিত অনেক খাদ্য থেকে বেশি। এতে ক্যালসিয়ামই আছে দুধের চেয়ে ৫ গুণ বেশি, ভিটামিন সি আছে কমলার চেয়ে ৭ গুণ বেশি, আর প্রোটিন মুরগির ডিম থেকেও ৩ গুণ বেশি!
অর্থাৎ নিয়মিত চিয়া সিড গ্রহণে আমরা প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি পেতে পারি যা আমাদের সাধারণ খাবার থেকে পাওয়া সবসময় সম্ভব না!
২. এন্টিঅক্সিডেন্টে পরিপূর্ণ
চিয়াসিডে কিছু নির্দিষ্ট এন্টিঅক্সিডেন্ট আছে যেমন ক্লোরোজেনিক এসিড, ক্যাফিক এসিড, মিরিসেটিন কিংবা কোয়েরসেটিন।
এরা শরীরে বেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। মুক্ত রেডিক্যালের সাথে যুদ্ধ করে সেগুলোকে নিউট্রালাইজ করে দেয়, এতে কোষের ক্ষতি কম হয়। এছাড়া এই উপাদানগুলো হৃদপিন্ড আর কলিজার ক্যান্সার প্রতিরোধেও সাহায্য করে।
৩. ওজন হ্রাসে ভূমিকা রাখে
আপনি যদি ওজন কমাতে চান, তবে চিয়া সিড একটা বেশ ভালো খাবার হতে পারে!
এর কারণ চিয়াতে রয়েছে উচ্চ মাত্রার প্রোটিন আর ফাইবার। এগুলো যেমন ওজন কমাতে সাহায্য করে, তেমনি দৈনিক খাদ্য চাহিদা কমানোর মাধ্যমে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত রাখতেও সাহায্য করে।
প্রতিদিন ব্যায়ামের এক ঘণ্টা আগে কিংবা পরে এক গ্লাস পানিতে অথবা লেবুর শরবতে আধা চামচ চিয়া সিড খেলে ওজন হ্রাসের গতি বাড়ানো সম্ভব।
৪. হৃদরোগ হ্রাস করে
চিয়াতে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড হৃদরোগের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। এছাড়া কোয়েরসেটিন এন্টিঅক্সিডেন্টটিরও বেশ ভালো ভূমিকা রয়েছে হৃদপিন্ড সংক্রান্ত অন্যান্য ঝুঁকি হ্রাস করতে।
৫. হাড়ের সুস্থতা নিশ্চিত করে
চিয়া সিডের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ হল – ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আর ম্যাগনেসিয়াম। তিনটি উপাদানই চিয়া সিডে রয়েছে বেশ উচ্চ মাত্রার, আর তিনটিই হাড়ের সুস্বাস্থ্যের জন্যে অতীব প্রয়োজন।
এই উপাদানগুলো হাড়ের ঘনত্ব ঠিক রাখে। যার ফলে বয়সের সাথে যে হাড় ভঙ্গুর হয়ে পড়ে – এই ব্যাপারটি কিছুটা হলেও এড়ানো যায়।
এছাড়া চিয়া সিডের এন্টি-ইনফ্লেমশন প্রভাব হাঁটু বা অন্যান্য জোড়ার ব্যথা উপশমেও ভূমিকা রাখে।
৬. রক্তচাপ ও রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে
নিয়মিত চিয়া সিড গ্রহণে রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে, কারণ এই খাবারটি উচ্চ রক্তচাপ কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। চিয়া সিডের এমন প্রভাব শেষমেশ হৃদপিন্ডের রোগের ঝুঁকি কমাতেই সহায়তা করে।
এছাড়া, যারা চিয়া সিড গ্রহণ করেন, তাদের রক্তের শর্করার মাত্রাও নিয়ন্ত্রিত হতে দেখা গিয়েছে। এর কারণ হিসেবে দেখা হয় চিয়া সিডে থাকা উচ্চ মাত্রার খাদ্যআঁশ।
সাধারণত কোনো একটা কিছু খাওয়ার পর হুট করে রক্তের শর্করার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। কিন্তু চিয়া সিড গ্রহণে দেখা গিয়েছে, এই মাত্রা অধিকাংশ সময় নিয়ন্ত্রিত থাকে।
এছাড়া ইনসুলিন সেন্সিটিভিটিকেও উন্নত করে চিয়া সিড। একারণে এই খাবারটি খেয়ে যাদের মেটাবোলিক সিন্ড্রোম, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, কিংবা হৃদরোগের সমস্যা আছে, তারা উপকার পেতে পারেন।
৭. কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে
দেহের সবচেয়ে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল হল লো ডেন্সিটি লিপোপ্রোটিন, আর চিয়া সিড একে কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখে। এছাড়া হাই ডেন্সিটি লিপোপ্রোটিন – যেটা আমাদের কাছে ‘ভালো কোলেস্টেরল’ হিসেবে পরিচিত, সেটির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় চিয়া সিড গ্রহণে।
কীভাবে খাবেন চিয়া সিড?
চিয়া সিড নানাভাবেই গ্রহণ করা যায়, আর সবক্ষেত্রেই এর অসাধারণ সব উপকারিতা লাভ করা সম্ভব। একইভাবে খেতে খেতে অনীহা চলে আসলে আপনি একটু সৃজনশীলও হয়ে উঠতে পারেন এই ব্যাপারে! তবে অবশ্যই খাওয়ার পূর্বে ১৫-২০ মিনিট বিশুদ্ধ পানিতে ভিজিয়ে রেখে দিবেন বীজগুলোকে।
জেনে নিন কীভাবে খাওয়া যেতে পারে চিয়া সিড-
- প্রতি গ্লাস লেবু, পুদিনা মিশ্রিত শরবতের সাথে আধা চামচ করে।
- কমলার জুস, বা স্মুদির সাথেও মিশিয়ে খেতে পারেন।
- সকালবেলার ওটস কিংবা বাড়িতে বানানো কাস্টার্ড বা পুডিং এও মিলিয়ে নিতে পারেন চিয়া সিড।
- রান্না করা সবজি বা সালাদের সাথে।
শেষ কথা
নিয়মিত চিয়া সিড গ্রহণে আপনিও এর বহুমূখী অসাধারণ উপকারিতা লাভ করতে পারেন। ক্ষুদ্র এই বীজগুলো আপনাকে যেমন পুষ্টি দান করবে, তেমনি নিশ্চিত করবে সুস্বাস্থ্য ও সুস্থতা।
প্রশ্ন ও উত্তর
চিয়া সিড কতক্ষণ ভিজিয়ে রেখে খাওয়া উচিত?
উত্তরঃ চিয়া সিড ভিজিয়ে রেখে খেলে হজমে সহজ হয়। এ কারণে খাওয়ার পূর্বে ১৫-২০ মিনিট চিয়া সিড ভিজিয়ে রাখা উচিত।
চিয়া সিড খাওয়ার আদর্শ সময় কখন?
উত্তরঃ সব থেকে ভালো হয় যদি আপনি চিয়া সিড সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই গ্রহণ করেন। এছাড়া ব্যায়ামের আধাঘণ্টা পড়ে খাওয়াও শরীরের জন্যে বেশ ভালো।
চিয়া সিড বেশি খেলে কি হবে?
উত্তরঃ চিয়া সিড বেশি খাওয়ায় পেটের সমস্যাসহ রক্তচাপ বেশি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া অতিরিক্ত গ্রহণে প্রোস্টেট বা স্তন ক্যান্সারের সম্ভাবনাও বেড়ে যেতে পারে। তাই পরিমিত খাওয়া উত্তম।